ঢাকা, শুক্রবার, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২১ ভাদ্র ১৪৩২
শেয়ারবাজারে দ্রুত মুনাফা তোলার ৫টি ট্রেডিং টিপস

নিজস্ব প্রতিবেদক: শেয়ারবাজারে নিয়মিত লেনদেন করছেন, কিন্তু মাস শেষে লাভের খাতটা খুব একটা ভারী হচ্ছে না। অনেক সময় ভালো শেয়ার কিনেও সঠিক সময়ে বিক্রি করতে না পারার কারণে মুনাফা হাতছাড়া হয়ে যায়। আবার বাজারের উত্থান-পতনে হঠাৎ লোকসানও গুনতে হয়। আপনার যদি এমন অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে, তবে কিছু কৌশল আপনাকে হতে পারে সঠিক দিশারি।
শুধু মৌলভিত্তির ওপর নির্ভর করে বসে থাকাই সাফল্যের একমাত্র পথ নয়। বরং বাজারের ঢেউ চিনে নিয়ে কিছু প্রমাণিত কৌশল প্রয়োগ করলে একজন সাধারণ বিনিয়োগকারীও হয়ে উঠতে পারেন দক্ষ ট্রেডার। নিচে এমন পাঁচটি কৌশলের কথা বলা হলো, যেগুলো অনেক অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারীরাও উপেক্ষা করে বসেন।
১. সুইং ট্রেডিং: স্বল্পমেয়াদী ঢেউ থেকে মুনাফা
শেয়ারবাজারে দামের গতি কখনোই সরলরেখায় চলে না। বরং এটি ঢেউয়ের মতো ওঠানামা করে—একসময় কমে, আবার কিছু সময় পর বাড়ে। এই স্বল্পমেয়াদী ওঠানামার সুযোগ কাজে লাগিয়েই বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীরা সুইং ট্রেডিং করে থাকেন। এটি মূলত এমন একটি কৌশল, যেখানে দীর্ঘ সময় ধরে শেয়ার ধরে রাখার পরিবর্তে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দামের স্বাভাবিক ঢেউ ব্যবহার করে দ্রুত মুনাফা তোলা হয়।
সুইং ট্রেডিং সফলভাবে করতে হলে প্রথমেই বোঝা দরকার সাপোর্ট এবং রেজিস্ট্যান্স নামের দুটি মূল স্তর।
• সাপোর্ট: এটি হলো সেই প্রাইস লেভেল, যেখানে দাম পড়তে পড়তে একসময় থেমে যায় এবং আবার বাড়তে শুরু করে। সচেতন ট্রেডাররা এই লেভেলের কাছাকাছি শেয়ার কিনে থাকেন, কারণ এখানে ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম এবং দাম বাড়ার সম্ভাবনা বেশি।
• রেসিস্ট্যান্স: এটি হলো এমন একটি লেভেল, যেখানে শেয়ারের দাম বাড়তে বাড়তে একসময় বাধার মুখে পড়ে এবং আবার কমে যায়। বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীরা সাধারণত এই জায়গায় পৌঁছালে শেয়ার বিক্রি করে মুনাফা তুলে নেন।
শুধু দাম দেখে নয়, চার্ট বিশ্লেষণ করেও এই সংকেত পাওয়া যায়। Hammer, Bullish Engulfing বা Morning Star এর মতো ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্নগুলো দেখা দিলে ধরে নেওয়া যায়, দাম বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে, Shooting Star বা Bearish Engulfing দেখা দিলে সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে, কারণ তখন দাম কমার প্রবণতা দেখা দিতে পারে।
২. ভলিউম অ্যানালাইসিস: দাম নয়, ট্রেডিং ভলিউম দেখুন
শেয়ারবাজারে শুধু দামের ওঠানামা দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া যথেষ্ট নয়; বরং সেই দামের পেছনে কতজন বিনিয়োগকারী সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছেন, তা বোঝা যায় ভলিউম থেকে। ভলিউম হলো নির্দিষ্ট সময়ে মোট কতগুলো শেয়ার হাতবদল হলো তার পরিমাণ। এটি বাজারের অভ্যন্তরীণ শক্তি বা দুর্বলতার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে।
যখন কোনো শেয়ারের দাম বাড়ছে এবং একইসঙ্গে ভলিউম বা লেনদেনও উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে, তখন ধরে নেওয়া যায় বাজারে শক্তিশালী ক্রেতাদের চাপ আছে। এই ধরণের প্রবণতাকে বলা হয় শক্তিশালী ট্রেন্ড, যা সাধারণত কিছু সময়ের জন্য বজায় থাকে এবং বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি ভালো সুযোগ তৈরি করে।
অন্যদিকে, যদি দেখা যায় দাম বাড়ছে কিন্তু ভলিউম বাড়ছে না, বরং কমে যাচ্ছে, তবে সতর্ক হওয়া জরুরি। কারণ এটি হতে পারে বাজার নিয়ন্ত্রণকারীদের তৈরি করা একটি ফাঁদ। অনেক সময় প্রভাবশালী গ্রুপ অল্প সংখ্যক শেয়ার লেনদেন করে দাম কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে তোলে, যাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আগ্রহী হয়ে ক্রয় করে। পরে তারা শেয়ার ছেড়ে দিলে দাম দ্রুত নিচে নেমে যায়।
তাই একজন সচেতন বিনিয়োগকারীর জন্য ভলিউম অ্যানালাইসিস হলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি হাতিয়ার। দাম বাড়া বা কমার পাশাপাশি লেনদেনের পরিমাণ মিলিয়ে দেখলে বাজারের প্রকৃত দিক বোঝা যায় এবং ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঝুঁকি কমে আসে।
৩. সেক্টর রোটেশন: সময়ের আগে সেক্টর ধরুন
একই সময়ে সব সেক্টর ভালো করে না। অর্থনৈতিক অবস্থা ও মৌসুমি চাহিদার ওপর নির্ভর করে টাকা এক খাত থেকে অন্য খাতে প্রবাহিত হয়। যেমন—
• বাজেটের পর অবকাঠামো খাত (সিমেন্ট, স্টিল, পাওয়ার) শক্তিশালী হয়।
• ঈদের আগে ব্যাংক ও আর্থিক খাত সচল হয়।
• শীতকালে ফার্মাসিউটিক্যালস ও টেক্সটাইল খাত চাঙ্গা হয়।
৪. ডিভিডেন্ড ও রাইট শেয়ারের বাস্তবতা
শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের সময় অনেকেই শুধু ডিভিডেন্ড ঘোষণার খবরে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ডিভিডেন্ড ঘোষণার পরপরই শেয়ারের দাম অনেক সময় কমে যায়। কারণ, যারা শুধু ডিভিডেন্ড পাওয়ার জন্য শেয়ার কিনেছিলেন, তারা রেকর্ড ডেট শেষ হতেই বিক্রি করে দেন। এই পরিস্থিতিকে বলা হয় ‘ডিভিডেন্ড ফাঁদ’। তাই কেবল ঘোষণার দিন বা কাছাকাছি সময়ে শেয়ার কেনা হলে বিনিয়োগকারীরা প্রায়ই লোকসানের মুখে পড়েন। বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীরা এ কারণে ডিভিডেন্ড ঘোষণার অনেক আগেই বাজারে প্রবেশ করেন এবং কৌশলীভাবে দামে সুবিধা নেন।
অন্যদিকে, রাইট শেয়ারও বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি বড় সিদ্ধান্ত। সাধারণত রাইট শেয়ার ঘোষণার পর বাজারে অতিরিক্ত সরবরাহ সৃষ্টি হয়, যার ফলে শেয়ারের দাম সাময়িকভাবে কমে যায়। এতে অনেক বিনিয়োগকারী আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার ছেড়ে দেন। কিন্তু যদি সংশ্লিষ্ট কোম্পানির মৌলভিত্তি শক্তিশালী হয় এবং ভবিষ্যতে প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে, তবে রাইট শেয়ার দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক হয়ে উঠতে পারে। কারণ রাইট শেয়ারের মাধ্যমে কোম্পানি মূলধন বৃদ্ধি করে ব্যবসা সম্প্রসারণে যেতে পারে, যা পরে শেয়ারদরের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে সক্ষম।
সুতরাং, শুধু ঘোষণার খবরে ঝাঁপিয়ে না পড়ে, কোম্পানির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, আর্থিক স্বাস্থ্য এবং বাজারের বাস্তবতা বিশ্লেষণ করে ডিভিডেন্ড ও রাইট শেয়ারে বিনিয়োগ করাই হবে একজন সচেতন বিনিয়োগকারীর কৌশল।
৫. মানি ম্যানেজমেন্ট: লোকসান সীমাবদ্ধ রাখুন
আলী হায়দার: শেয়ারবাজারে লোকসান এড়ানো সম্ভব নয়, কিন্তু সেটি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এজন্য রিস্ক-রিওয়ার্ড রেশিও ব্যবহার করুন। প্রতিটি ট্রেডের আগে ঠিক করুন কতটুকু লাভে বিক্রি করবেন আর কতটুকু ক্ষতিতে বের হয়ে আসবেন। আদর্শ অনুপাত হলো ১:৩—অর্থাৎ ১ টাকা ক্ষতির বিপরীতে অন্তত ৩ টাকা লাভের সম্ভাবনা থাকলেই ট্রেড করুন।
সর্বোপরি, শেয়ারবাজারে সফল হতে হলে শুধু সঠিক সময়ে শেয়ার কেনা-বেচাই যথেষ্ট নয়; এর জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো ধৈর্য, শৃঙ্খলা এবং নিয়মিত শেখার মানসিকতা। বিনিয়োগকারীদের মনে রাখতে হবে, শেয়ারবাজার সবসময় এক রকম থাকে না—কখনো দাম বাড়বে, আবার কখনো হঠাৎ কমেও যেতে পারে। তাই স্বল্পমেয়াদী ওঠানামায় আতঙ্কিত হয়ে বা অতিরিক্ত লোভে পড়ে আবেগপ্রবণ সিদ্ধান্ত নিলে ক্ষতির ঝুঁকি বেড়ে যায়। বরং, একটি সুস্পষ্ট ট্রেডিং পরিকল্পনা তৈরি করে সেটির প্রতি অনুগত থাকা, ঝুঁকি-লাভের সঠিক হিসাব মেনে চলা এবং প্রতিটি অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। এই বিষয়গুলো গড়ে তুলতে পারলেই দীর্ঘমেয়াদে শেয়ারবাজার আপনার জন্য হয়ে উঠবে এক নির্ভরযোগ্য ও ধারাবাহিক মুনাফার উৎস।
লেখক: শেয়ারবাজার এনালিষ্ট
পাঠকের মতামত:
সর্বোচ্চ পঠিত
- বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে শেয়ারবাজারের ১১ কোম্পানিতে
- কোম্পানি পুরোদমে উৎপাদনে, তারপরও শঙ্কায় বিনিয়োগকারীরা!
- পাকিস্তান বনাম সংযুক্ত আরব আমিরাত সাম্প্রতিক ম্যাচের পরিসংখ্যান
- বিও অ্যাকাউন্টের ফি নিয়ে বিনিয়োগকারীদের সুখবর দিল বিএসইসি
- মার্জারের সাফল্যে উজ্জ্বল ফার কেমিক্যাল
- এক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ উচ্চতায় ৫ কোম্পানি
- শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির পর প্রথম ‘নো ডিভিডেন্ড’
- শেয়ারবাজারে মিডল্যান্ড ব্যাংকের নতুন যাত্রা
- তদন্তের খবরে থামছে দুই কোম্পানির ঘোড়দৌড়
- আট কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কাড়াকাড়ি
- নতুন উচ্চতায় অগ্রসর হচ্ছে দেশের শেয়ারবাজার
- সর্বনিম্ন দামে আটকে গেল ৭ কোম্পানির শেয়ার
- ডেনিম উৎপাদন বাড়াতে এভিন্স টেক্সটাইলসের বড় পরিকল্পনা
- চলতি সপ্তাহে ঘোষণা আসছে ৫ কোম্পানির ডিভিডেন্ড-ইপিএস
- পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কার পথে এগোচ্ছে বাংলাদেশের শেয়ারবাজার