ঢাকা, সোমবার, ১৮ আগস্ট ২০২৫, ২ ভাদ্র ১৪৩২

জিডিপির প্রবৃদ্ধি কমলে শেয়ারবাজারের ঝুঁকি বাড়ে কেন?

ডুয়া নিউজ- শেয়ারবাজার
২০২৫ আগস্ট ১৭ ১৯:৪৮:২৯
জিডিপির প্রবৃদ্ধি কমলে শেয়ারবাজারের ঝুঁকি বাড়ে কেন?

সাইফুল ইসলাম পিপন:বাংলাদেশ গত দুই দশকে ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা, জ্বালানি সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি দেশের প্রবৃদ্ধির গতি শ্লথ করেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৩.৯৭ শতাংশে, যা লক্ষ্য নির্ধারিত ৫.২৫ শতাংশের তুলনায় অনেক কম। কোভিড-পরবর্তী সময়ের মধ্যে এটিই সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি। আন্তর্জাতিক সংস্থা বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবিও প্রায় একই ধরনের পূর্বাভাস দিয়েছিল, যা ছিল ৩.৮ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে।

প্রবৃদ্ধির এই মন্থরতা খাতভিত্তিকভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কৃষি খাত সবচেয়ে বেশি চাপে রয়েছে, যার প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ১.৭৯ শতাংশে। জলবায়ু ঝুঁকি, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি ও বাজারমূল্যের অস্থিরতা এর প্রধান কারণ। শিল্প খাত কিছুটা ভালো করেছে— ৪.৩৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, যদিও বিদ্যুৎ সংকট, ডলার সংকট ও কাঁচামালের উচ্চমূল্য এ খাতের সম্প্রসারণ সীমিত করেছে। সেবা খাত তুলনামূলক ভালো পারফর্ম করেছে— ৪.৫১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি, যা বাণিজ্য, পরিবহন ও আর্থিক খাতের ধীর কিন্তু স্থিতিশীল পুনরুদ্ধারের ফল।

বিনিয়োগের দিক থেকে চিত্র তেমন আশাব্যঞ্জক নয়। মোট বিনিয়োগের অনুপাতে জিডিপি দাঁড়িয়েছে ২৯.৩৯ শতাংশ, যা আগের বছরের ৩০.৭০ শতাংশ থেকে কম। জাতীয় সঞ্চয়ের হার সামান্য বেড়েছে, কিন্তু বেসরকারি বিনিয়োগ গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে। বিনিয়োগ হ্রাস মানে উৎপাদন সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা এবং কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা কমে যাওয়া— যা দীর্ঘমেয়াদে প্রবৃদ্ধির ভিত্তিকে দুর্বল করে।

এই অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের প্রতিফলন সরাসরি দেখা যায় দেশের শেয়ারবাজারে। ২০২৫ সালের জুলাই মাসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে এক ধরনের উত্থান লক্ষ্য করা যায়। প্রধান সূচক ডিএসইএক্স এক মাসে ১২.৫০ শতাংশ বেড়ে এশিয়ার তৃতীয় সর্বোচ্চ পারফরমার হয়। গড় দৈনিক লেনদেন প্রায় ৭৩০ কোটি টাকায় পৌঁছে যায়, যা জুন মাসের তুলনায় ১১৯ শতাংশ বেশি। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আশাবাদ ফিরে আসে— এর পেছনে ভূমিকা রাখে নীতিগত সিদ্ধান্ত, শেয়ারমূল্যের সংশোধনের পর বাজারের সস্তা দরে আকর্ষণ এবং কিছু বিদেশি বিনিয়োগকারীর আগ্রহ।

তবে এই উত্থান দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। আগস্টের শুরুতেই সূচক ও লেনদেন আবার নিম্নমুখী হয়— ৪ আগস্টে লেনদেন নেমে আসে ৯.১ বিলিয়ন টাকায়, যা মাসের শুরু থেকে প্রায় ২০ শতাংশ কম। এই ধরণের স্বল্পস্থায়ী র‌্যালি প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের শেয়ারবাজার এখনও অনেকাংশে স্বল্পমেয়াদি নীতি, বিনিয়োগকারীর মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া এবং জল্পনাকেন্দ্রিক লেনদেনের ওপর নির্ভরশীল।

আর্থিক তত্ত্ব অনুযায়ী, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও শেয়ারবাজারের মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। অর্থনীতি যখন প্রবৃদ্ধির ধারায় থাকে, তখন কোম্পানির বিক্রি ও মুনাফা বাড়ে, যা বিনিয়োগকারীর আস্থা তৈরি করে এবং শেয়ারমূল্য বাড়ায়। প্রবৃদ্ধি মন্থর হলে এর বিপরীত প্রভাব পড়ে— বিনিয়োগ কমে, উৎপাদন ও বিক্রি হ্রাস পায়, আর শেয়ারমূল্য নিম্নমুখী হয়। বাংলাদেশে এ সম্পর্ক পুরোপুরি সরলরৈখিক নয়। বাজারে অনেক সময় নীতি-প্রণোদনা বা হঠাৎ বিধিনিষেধের কারণে সূচক অর্থনীতির বাস্তব অবস্থার বাইরে গিয়েও ওঠানামা করে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ শতাংশের বেশি, বাজারও তখন স্থিতিশীল ঊর্ধ্বমুখী ছিল। ২০২০ সালে প্রবৃদ্ধি ৩.৪৫ শতাংশে নেমে এলে বাজারে ধস নামে, কিন্তু পরের বছর অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোয় সূচকও পুনরুদ্ধার হয়।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে দেখা যায়— যুক্তরাষ্ট্র, ভারত বা জাপানের মতো অর্থনীতিতে শেয়ারবাজার প্রায়শই জিডিপি প্রবৃদ্ধির একটি ‘লিডিং ইন্ডিকেটর’ হিসেবে কাজ করে, অর্থাৎ বাজারের গতিপ্রকৃতি অনেক সময় ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক প্রবণতার আভাস দেয়। কিন্তু বাংলাদেশের বাজার এখনও তুলনামূলকভাবে নীতিনির্ভর, যেখানে বিনিয়োগকারীর মনস্তত্ত্ব ও গুজবের প্রভাব বেশি। ফলে এখানে শেয়ারবাজার সবসময় অর্থনীতির বাস্তব অবস্থা সঠিকভাবে প্রতিফলিত করে না।

ভবিষ্যতের জন্য দুটি দিক সমান্তরালে জোর দেওয়া জরুরি— একটি হলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি টেকসই রাখা, অন্যটি হলো শেয়ারবাজারকে শক্তিশালী করা। এর জন্য বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি, জ্বালানি ও কাঁচামালের স্থিতিশীল সরবরাহ, বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের স্থিতিশীলতা, স্বচ্ছ ও পূর্বানুমেয় নীতিমালা জরুরি। পাশাপাশি আইপিও প্রক্রিয়া সহজ করা, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো এবং ব্যাংক ও বস্ত্রশিল্প ছাড়াও প্রযুক্তি, ওষুধ, নবায়নযোগ্য জ্বালানির মতো খাতকে বাজারে যুক্ত করা দরকার।

বাংলাদেশের তরুণ জনশক্তি, বিস্তৃত ভোক্তা বাজার এবং রপ্তানির বৈচিত্র্য ভবিষ্যতের প্রবৃদ্ধিকে এগিয়ে নিতে পারে— যদি বিনিয়োগ ও বাজার সংস্কার সমান্তরালে হয়। শেয়ারবাজার এ সম্ভাবনাকে প্রতিফলিত করতে সক্ষম, কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন স্থিতিশীল অর্থনীতি ও আস্থাশীল বিনিয়োগ পরিবেশ। দীর্ঘমেয়াদে একটি শক্তিশালী অর্থনীতি ছাড়া শেয়ারবাজারের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই নীতিনির্ধারকদের উচিত প্রবৃদ্ধি ও বাজার সংস্কারকে একই কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গ্রহণ করা, যাতে দুটোই একে অপরকে পরিপূরকভাবে এগিয়ে নিতে পারে।

লেখক শেয়ারবাজার বিশ্লেষক

পাঠকের মতামত:

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

সর্বোচ্চ পঠিত