ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫, ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বাংলাদেশি পরিচয়ে আবেদন

ফ্রান্সে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে ভারতীয়রা

২০২৫ মে ২২ ১৯:২৪:৫৩
ফ্রান্সে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে ভারতীয়রা

ডুয়া ডেস্ক: ফ্রান্সসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় পেতে কিছু ভারতীয় নাগরিক নিজেদের বাংলাদেশি পরিচয়ে উপস্থাপন করছেন- এমন জালিয়াতির ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে।

এই ব্যক্তিরা ভুয়া নথিপত্র ও কল্পিত পরিচয় ব্যবহার করে নিজেদের রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হিসেবে তুলে ধরে মানবিক আশ্রয়ের আবেদন করছেন। এতে শুধু যে আইনি জটিলতা তৈরি হচ্ছে তা নয়, বরং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিকর ও নেতিবাচক তথ্য ছড়ানোও হচ্ছে।

এই প্রবণতা মানবিক, আইনি ও কূটনৈতিক- তিন দিক থেকেই গভীর উদ্বেগের।

ন্যাশনাল কোর্ট অব অ্যাসাইলাম (CNDA) ও ফরাসি গণমাধ্যম লো মন্ডের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ‘২০১৭ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার বাসিন্দা বিষ্ণজিৎ দাস ও তার স্ত্রী রিঙ্কু দাস ফ্রান্সে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেন বাংলাদেশি পরিচয়ে।’

‘তারা একটি দালাল চক্রের মাধ্যমে ভুয়া জন্মসনদ, নাগরিকত্ব সনদ ও অন্য নথিপত্র সংগ্রহ করে প্যারিসে পাড়ি জমান। OFPRA (Office Français de Protection des Réfugiés et Apatrides) আশ্রয় মঞ্জুর করে।’

২০২২ সালের জুলাই মাসে দিল্লি বিমানবন্দরে নামার পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে একসঙ্গে ভারতীয় পরিচয়পত্র ও ফ্রান্সে আশ্রয়প্রাপ্তদের কাগজপত্র উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাদের আটক করে এবং ফৌজদারি আইনে মামলা দায়ের করে।

তারা কেন আশ্রয় আবেদন করতে গিয়ে বাংলাদেশি পরিচয় ব্যবহার করেন, এ বিষয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন—

বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় নিপীড়ন ও রাজনৈতিক দমন-পীড়নের অভিযোগ তুললে ইউরোপে আশ্রয় পাওয়ার সুযোগ তুলনামূলক সহজ। এ সুযোগকেই কাজে লাগাচ্ছে ভারতীয় কিছু দালালচক্র, যারা মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে ভুয়া বাংলাদেশি নথিপত্র সরবরাহ করছে।’

সীমান্তবর্তী জেলা, যেমন মালদা, মুর্শিদাবাদ ও নদিয়া থেকে এই ধরনের প্রবণতা শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। এসব অঞ্চলে সক্রিয় দালালচক্র স্থানীয় প্রশাসনের নজর এড়িয়ে ফরাসি ভাষায় অনুবাদসহ ভুয়া কাগজপত্র প্রস্তুত করে দিচ্ছে।

২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে দুবাই থেকে নিকারাগুয়া যাওয়ার পথে একটি চার্টার্ড ফ্লাইট ফ্রান্সের ভাত্রি বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করে। বিমানে থাকা তিন শতাধিক যাত্রীর মধ্যে ২৫ জন ভারতীয় নাগরিক ফ্রান্সে আশ্রয়ের আবেদন করেন। আশ্রয়প্রার্থীদের অনেকেই নিজেদের বাংলাদেশের নাগরিক বলে দাবি করেন।

তবে ফরাসি আদালতে সময়মতো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে না পারায় তাদের মুক্তি দেওয়া হয়। বর্তমানে তারা ফ্রান্সে অনিয়মিতভাবে অবস্থান করছেন।

এদিকে মিথ্যা পরিচয় ও জাল নথির কারণে ফ্রান্সে আশ্রয় আবেদনগুলো ‘দ্রুত প্রক্রিয়াকরণ’ তালিকায় চলে আসছে। যা আশ্রয় ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও বৈধ আবেদনকারীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে।

এই পদ্ধতিতে দ্রুত তথ্য যাচাই করে স্বল্প সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে অনেক ক্ষেত্রে প্রতারণার বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে ধরা পড়ে না। ফলে অনেকে দীর্ঘদিন ফ্রান্সে বসবাসের সুযোগ পান। এমনকি স্থানীয় কাজে যুক্তও হন। পরবর্তী সময়ে ধরা পড়লে এসব সুবিধা ও স্থিতি কেড়ে নেওয়া হয়।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন বিশ্লেষক ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ফ্রান্সের রিজিওনাল কোঅর্ডিনেটর সামান্থা ভার বলেন, “এটি শুধু একটি আইনি নয়, নৈতিক সংকটও বটে! দক্ষিণ এশীয় রাষ্ট্রগুলোতে অভ্যন্তরীণ সমস্যা থাকলেও মিথ্যা পরিচয়ে আশ্রয় নেওয়া বৈধ অভিবাসন প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে তোলে।”

ফরাসি অভিবাসন আইনজীবী বাহায়ি আগাহী আলাউই বলেন, “জাল পরিচয় ও নথিপত্রের মাধ্যমে আশ্রয় লাভ শুধু আইন লঙ্ঘন নয়, ফ্রান্সের নিরাপত্তা ও মানবাধিকার নীতির ওপরও আঘাত। আমাদের সিস্টেমে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে আইনি সংস্কার জরুরি।”

এ বিষয়ে ফ্রান্স-বাংলাদেশ কালচারাল কমিউনিটির সভাপতি আসিফ ইকবাল বলেন, “ফ্রান্সে বহু বাংলাদেশি বৈধভাবে কাজ ও পড়াশোনা করছেন; কিন্তু এ ধরনের প্রতারণার ফলে আমাদের পরিচয়ই সন্দেহের মুখে পড়ছে।”

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ও ফ্রান্সের নিস বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক আইনের প্রফেসর ম্যারি পিয়েখ বলেন, “এ সমস্যা একক কোনো দেশের নয়। ভারত-বাংলাদেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে অভিবাসন সংক্রান্ত ত্রিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান জরুরি।”

অভিবাসনের আড়ালে এই ধরনের প্রতারণা একটি নীরব মানবিক সংকট তৈরি করছে। এটি শুধু আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, সামাজিক সচেতনতা ও শিক্ষার মাধ্যমেও প্রতিরোধ করতে হবে।

ফ্রান্সে বাংলাদেশি পরিচয় নিয়ে ভারতীয় নাগরিকদের আশ্রয় গ্রহণের এই প্রবণতা আন্তর্জাতিক অভিবাসন ব্যবস্থার জন্য একটি গুরুতর সতর্ক সংকেত। বিষয়টি আইন, মানবিক মূল্যবোধ ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক এ তিনটি স্তরেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা ঠেকাতে প্রয়োজন জনসচেতনতা, কঠোর আইন প্রয়োগ এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ।

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

প্রবাস এর সর্বশেষ খবর

প্রবাস - এর সব খবর



রে