ঢাকা, শনিবার, ১৯ জুলাই ২০২৫, ৪ শ্রাবণ ১৪৩২

স্মৃতির পাতায় শাকীল পারভেজ

ডুয়া নিউজ- জাতীয়
২০২৫ জুলাই ১৯ ২১:৩৯:৩৭
স্মৃতির পাতায় শাকীল পারভেজ

ড. এ. কে. আজাদ : আমার একজন প্রিয় ছাত্র মোঃ শাকিল হোসেন, যিনি শাকীল পারভেজ নামেই পরিচিত, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিবিএ প্রোগ্রামের আশুলিয়া ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থী ছিল। 'বেসিক কনসেপ্ট অব ইসলাম' এবং 'বাংলাদেশ স্টাডিজ' — এই দুটি কোর্সে তার সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। একজন শিক্ষক হিসেবে আমি মুগ্ধ ছিলাম তার মেধা ও ক্লাসে অসাধারণ পারফর্মেন্স দেখে।

শাকিল কেবল একজন ভালো ছাত্রই ছিল না, তার মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলিও ছিল চোখে পড়ার মতো। 'বাংলাদেশ স্টাডিজ' কোর্সের অধীনে ঢাকার মধ্যে আমাদের একটি স্টাডি টুর ছিল, যার প্রধান দায়িত্বভার শাকিলের ওপর ন্যস্ত ছিল। সে অত্যন্ত নিষ্ঠা ও দক্ষতার সাথে টুরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি দায়িত্ব পালন করেছিল, যা আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।

আজও আমি ভাবি, শাকিল আর আমার আশুলিয়া অফিসে আসবে না, বলবে না, "স্যার, আবার আপনার সাথে ঘুরতে যাবো। আপনার ক্লাসগুলো খুব মিস করি।" সে আর জানতে চাইবে না, "স্যার, আমাকে বিভিন্ন সেমিনারে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েন," কিংবা "স্যার, কীভাবে বিদেশে স্কলারশিপ পাওয়া যায়?" নানা সমস্যার কথা জানাতে বা কোনো সুখবর নিয়েও সে আর আসবে না।

শাকিলের শাহাদাতের দিনটি ছিল ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার (২ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ মুহাররম ১৪৪৬ হিজরি)। মুহাররমের শেষ রোজা রেখেছিলাম আমি। আসরের নামাজের পর ফেসবুক খুলতেই শাকিলের মৃত্যু সংবাদ আমার চোখে পড়ে। জানতে পারি, কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে উত্তরা এলাকায় পুলিশের গুলিতে সে শাহাদত বরণ করেছে। খবরটি প্রথমে কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সাথে সাথে শাকিলকে ফোন দিলাম, কিন্তু তাকে না পেয়ে আরেকজন ছাত্রকে ফোন করে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হলাম। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি স্যার, প্রক্টর, সহকারী প্রক্টর, ডিন, রেজিস্ট্রার, ডেপুটি রেজিস্ট্রার, কো-অর্ডিনেটরসহ বেশ কয়েকজন সহকর্মীর সাথে ফোনে কথা বললাম।

এর মধ্যেই মাগরিবের আজান পড়ল। মাইকে আজানের ধ্বনির সাথে সাথে শিয়া মসজিদ, মোহাম্মদপুর এলাকায় গোলাগুলির শব্দ কানে আসছিল, সাথে ছিল মিছিলের কোলাহল আর মানুষের ছোটাছুটি। কোনোমতে ইফতার ও নামাজ শেষ করে আমার সহধর্মিণী ও ছোট দুটি সন্তানকে বললাম যে আমি বাইরে যাচ্ছি, তাদের দোয়া চাইলাম। মহান আল্লাহর নাম নিয়ে আমি বের হলাম।

কিছুদূর হাঁটার পর একটি রিকশা পেলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, "ভাই, শ্যামলী যাবেন?" রিকশাচালক উত্তর দিল, "ভাই, ওদিকে মারামারি হচ্ছে, আমি যাইয়াম না।" আরও কিছুদূর হাঁটার পর আরেকটি রিকশা পেলাম। অনেক অনুরোধ এবং তিনগুণ ভাড়া বেশি দেওয়ার শর্তে সে রাজি হলো। কয়েক মিনিটের মধ্যেই শ্যামলীতে পৌঁছলাম। রাস্তায় পুলিশ, বিজিবির গাড়ি এবং দু'একটি রিকশা ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ল না। শ্যামলীতে গিয়ে একটি সিএনজি পেলাম, সেটি করে মাজার রোড পর্যন্ত গেলাম, কারণ চালক এর বেশি যেতে রাজি ছিল না। সেখান থেকে আরেকটি সিএনজি নিয়ে বিরুলিয়া ব্রিজ পর্যন্ত পৌঁছলাম। রাস্তায় তেমন কোনো যানবাহন ছিল না, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নজরদারি চোখে পড়ছিল। বিরুলিয়া ব্রিজ থেকে অটোরিকশা নিয়ে মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুলিয়া ক্যাম্পাসে পৌঁছলাম। ফ্রিজ অ্যাম্বুলেন্সে আমার সদা হাস্যোজ্জ্বল শাকিলকে নীরবে ঘুমাতে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লাম। নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করলাম এই ভেবে যে, আমি যদি ভেঙে পড়ি, তাহলে ছাত্র-ছাত্রীদের অবস্থা কী হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জানাজা নামাজে দাঁড়িয়ে গেলাম। নামাজ শেষে শাকিলের লাশ নিয়ে যাওয়া হলো তামিরুল মিল্লাতের গাজীপুর ক্যাম্পাসে এবং সেখান থেকে তার গাজীপুরের বাসায়।

এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, রেজিস্ট্রার, প্রক্টর, ছাত্র উপদেষ্টা, সহকারী প্রক্টর, শিক্ষক ও কর্মকর্তারা সবাই মিলে ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে একটি মিটিংয়ে বসলেন এবং তাদের কথা শুনলেন। শিক্ষার্থীরা প্রক্টরের কাছে তাদের দাবিগুলো লিখিত আকারে জমা দিল। এই ভয়াল রাতে কার লাশ নিয়ে যাওয়া হবে, তা নিয়ে চলছিল দীর্ঘ আলোচনা। অনেকেই সেদিন রাতে যাওয়ার ব্যাপারে পিছপা হলেন। দায়িত্বে থাকা অনেক ব্যক্তি পরের দিন যাওয়ার কথা বললেও বাস্তবে আর যাওয়া হয়নি। অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তি সেই ভয়াবহতার কারণে জানাজার নামাজেও আসতে পারেননি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশনায় রাত দশটার দিকে আশুলিয়া ক্যাম্পাস থেকে আমার নেতৃত্বে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও ছাত্রসহ দশ সদস্যের একটি দল নিয়ে আমরা গাজীপুরের দিকে রওনা হলাম, কারণ শাকিলকে তার গাজীপুরের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আব্দুল্লাহপুর পৌঁছাতেই একদল লোক লাঠি দেখিয়ে আমাদের গাড়ি উল্টো ঘুরিয়ে দিতে বলল। গাড়ির চালক বাবুল ভাই জিজ্ঞেস করলেন, "কী করব স্যার? ওরা তো গাড়ি ভেঙে ফেলতে পারে, গাড়ি জ্বালিয়েও দিতে পারে।" আমি বললাম, "বাবুল ভাই, পিছনে ফেরার কোনো উপায় নেই। এখন ডু অর ডাই! সামনে এগিয়ে যেতে হবে।" গাড়ি এগিয়ে গেল, আমরা পরিচয় দিলাম, কথা বললাম। তারা আমাদের গাড়ির দরজা খুলে চেক করল, লাইট মেরে আমাদের চেহারা দেখল। তারপর যেতে দিল। এভাবে বেশ কয়েকবার আমাদের গাড়ি চেকের সম্মুখীন হলো। প্রতিবারই যখন হাতে লাঠি নিয়ে কিংবা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে আমাদের গাড়ি থামিয়ে চেক করছিল, তখন আমরা কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে পড়ছিলাম। কারণ আমরা অনেক গাড়ি জ্বালিয়ে দিতে দেখেছি, অনেক মানুষকে হতাহত হতে দেখেছি, অনেককে বন্দী করে নিয়ে যেতে দেখেছি, নির্মম অত্যাচারের দৃশ্য দেখেছি। কিন্তু যতবারই আমরা ভয় পেয়েছি, আমার মনে হয়েছে শাকিল আমাকে বলছে, "স্যার, ভয় পাবেন না, আমি আপনাদের সাথে আছি।" মহান আল্লাহর অসীম কৃপায় আমার বারবার একথাই মনে হয়েছে। শাকিলের গাড়ি যখনই একটু পিছনে পড়ে যাচ্ছিল, তখনই আমার ভয়, চিন্তা ও উদ্বেগ বেড়ে যাচ্ছিল যে, আমরা ঠিকমতো পৌঁছাতে পারব তো? মনে হচ্ছিল শাকিল বারবার বলছে, "স্যার, চিন্তিত হবেন না। আমি তো আছি!" ফজরের আজানের শব্দ শুনলাম, মনে হলো শাকিল বলছে, "স্যার, নামাজ পড়ে নিন।" রাস্তার পাশে মসজিদ দেখে গাড়ি থামিয়ে আমরা ফজরের নামাজ পড়তে দাঁড়ালে আমার মনে হলো শাকিল কোথায়? শাকিল বলল, "আমার জন্য চিন্তা করবেন না, আমি তো আপনাদের পিছনেই আছি।" নামাজ শেষে আবার আমাদের যাত্রা শুরু হলো। এরই মধ্যে শাকিলকে বহনকারী গাড়ির পিছনের বাম পাশের দুটি চাকাই নষ্ট হয়ে গেল।

লেখক মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষকএবং ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন-ডুয়ার একজন সদস্য।

পাঠকের মতামত:

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

সর্বোচ্চ পঠিত